নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে একই চিত্রনাট্য লিখলো বাংলাদেশ। দুই বছর ১১ দিন আগে এই স্টেডিয়ামে নেপালকে হারিয়ে নারী সাফে প্রথম শিরোপা জিতেছিল সাবিনা-কৃষ্ণারা। এবারো শেষ বাঁশি বাজতেই দশরথের গ্যালারিকে স্তব্ধ করে উল্লাসে ফেটে পড়ে বাংলাদেশের মেয়েরা। সেই নেপালকে আবারো হতাশায় ভাসিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখলো বাংলাদেশ। ফাইনালের জমজমাট লড়াই শেষে বাংলাদেশের জয় ২-১ গোলে। শুরুতে বাংলাদেশের হয়ে গোল করেন মনিকা চাকমা। এরপর আমিশা কার্কির গোলে সমতা ফেরায় নেপাল। তবে শেষদিকে ঋতুপর্ণা চাকমার দারুণ এক গোলে শিরোপা নিশ্চিত করেন সাবিনারা। গত আসরে এই নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। গত আসরের মতো এবারো সাউথ এশিয়ার সেরা গোলরক্ষক হয়েছেন রুপনা চাকমা। টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন ঋতুপর্ণা চাকমা।
আসরের শুরুটা যে মোটেও ভালো হয়নি তাদের। প্রথম ম্যাচে দুর্বল পাকিস্তানের বিপক্ষে অপ্রত্যাশিতভাবে হারের মুখে পড়ে গিয়েছিল সাবিনারা, শেষ মুহূর্তের গোলে ড্রয়ে মাঠ ছাড়ে তারা। এরপর আসতে থাকে দলের মধ্যে ‘কোন্দল আর টানাপড়েনের’ খবর। তবে সব বাধা সামলে ভারতকে হারিয়ে গ্রুপসেরা হয়ে সেমিফাইনালে উঠে বাংলাদেশ। সেখানে ভুটানকে ধসিয়ে পায় ফাইনালের টিকিট। পায়ের চোট কাটিয়ে ফাইনালে ফিরেন শামসুন্নাহার জুনিয়র, তাতে বেঞ্চে জায়গা হয় সাগরিকার। নেপালের বিপক্ষে দুই বছর আগের ফাইনালে দুর্দান্ত এক গোলে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়েছিলেন এই শামসুন্নাহার। ভারত ম্যাচে লালকার্ড দেখা রেখা পোডেলকে ফাইনালে পায়নি নেপাল। ৭ গোল করা এই ফরোয়ার্ডের অনুপস্থিতিতে আক্রমণ ভাগের দায়িত্ব ওঠে সাবিত্রা ভাণ্ডারীর কাঁধে। তবে প্রথমার্ধ্বে ফরাসি লীগে খেলা এই তারকাকে কড়া পাহারায় রাখেন আফিদা খন্দকার ও শিউলি আজিম। টইটমু্বর স্টেডিয়ামে ম্যাচের দ্বিতীয় মিনিটেই দারুণ এক সুযোগ পায় তহুরা খাতুন। নিজের কাজটাও করেছিলেন বাংলাদেশি স্ট্রাইকার। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় গোলপোস্ট। প্রতিপক্ষের এক খেলোয়াড় গোলকিক নেয়ার সময় পড়ে গেলে তাতে শট জোরালো হয় না। নেপালের ডি-বক্সের সামনেই দাঁড়ানো তহুরা বল পান। গোলরক্ষককে একা পেয়ে শটও নিলেন তিনি। কিন্তু আসলে পাঁচ গোল করা তহুরার শট বারে লেগে ফিরে আসে। দ্বিতীয়বার সুযোগ পেয়ে হেড দিলে তা ধরে ফেলেন গোলরক্ষক অঞ্জিলা সুব্বা। এই গোলবারই নেপালকে হতাশ করে ১০ মিনিটে। আমিশা কারকির শট বারে লেগে ফিরে আসে। ৩৫ মিনিটে দারুণ এক সুযোগ পেয়েছিলেন মনিকা চাকমা। গোলরক্ষক অঞ্জিলা গোলবার থেকে বের হয়ে এসে বাংলাদেশের একটি ক্রস প্রতিহত করলে ফাঁকা গোলবারেও বল জালে জড়াতে পারেননি মনিকা। প্রথমার্ধ্বে কোনো দল গোল না পেলেও বাংলাদেশের রক্ষণভাগকে ব্যতিব্যস্ত রেখেছিলেন সাবিত্রা ভাণ্ডারী। বক্সে বেশ কিছু বল বাড়িয়েছিলেন তিনি। যা থেকে গোলও পেতে পারতো নেপাল যদি তার সতীর্থরা ঠিকমতো সুযোগগুলো কাজে লাগাতে পারতো। তবে সেই সুযোগ দেয়নি বাংলাদেশের রক্ষণভাগের খেলোয়াড়রা। বিরতির পরেই লিড নেয় বাংলাদেশ। ৫২ মিনিটে সাবিনার বাড়ানো বল প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগের খেলোয়াড়রা ঠিকমতো ক্লিয়ার করতে না পারলে সেই সুযোগ নেন মনিকা চাকমা। ডান প্রান্ত থেকে নেপালের গোলরক্ষক অঞ্জিলাকে ফাঁকি দেন তিনি। তিন মিনিট পরেই অবশ্য দশরথ স্টেডিয়ামে জনসমুদ্রের গর্জন শুরু হয়। ১৬ হাজারেরও বেশি দর্শককে আনন্দে ভাসান আমিশা। ৫৬ মিনিটে প্রীতি রাইয়ের অবিশ্বাস্য এক পাসে গোলরক্ষক রুপনা চাকমাকে পরাস্থ করেন আমিশা। রক্ষণ চেরা পাসে শুধু বলকে পথ দেখানোই বাকি ছিল। সমতায় ফেরার চতুর্থ মিনিটের মাথায় আরেকটি সুযোগ পেয়েছিল স্বাগতিকরা। তবে সাবিত্রা বাঁ-প্রান্তের দুরূহ কোণ থেকে যে শট নিলেন তা ডান প্রান্তের গোলবারের বাইরে দিয়ে যায়। ৬৮ মিনিটে নেপালকে বড় বাঁচা বাঁচিয়েছেন অঞ্জিলা। নিশ্চিত গোলকে যেভাবে শূন্যে লাফ দিয়ে কর্নারের বিনিময়ে রক্ষা করলেন তা এককথায় অবিশ্বাস্য। বক্সের বাইরে থেকে চোখ-ধাঁধানো এক শট নিয়েছিলেন মারিয়া মান্দা। কিন্তু বাঁ-প্রান্তে লাফ দিয়ে দারুণ সেইফ দিলেন নেপালের গোলরক্ষক। গ্যালারিতে থাকা নেপালের উত্তাল জনসমুদ্রকে থামানোর দুর্দান্ত এক সুযোগ পেয়েছিল বাংলাদেশ। তবে ৭৭ মিনিটে বাঁ-প্রান্ত থেকে ঋতুপর্ণা চাকমার ক্রসে ঠিকমতো হেড নিতে পারেননি শামসুন্নাহার জুনিয়র। তবে ৮১ মিনিটে ঠিকই ১৬ হাজারের বেশি সমর্থককে বাকরুদ্ধ করে দিলেন ঋতুপর্ণা। বাঁ-প্রান্ত থেকে প্রায় টাচ লাইন থেকে যে শটটা নিলেন তা এককথায় অবর্ণনীয়। নেপালের গোলরক্ষক শূন্যে লাফ দিয়ে বিশ্বস্ত হাতে বলকে বাইরে পাঠানোর চেষ্টা করলেও ঋতুর মাপা শটকে হার মানাতে পারেননি। পুরো আসরে দারুণ খেলা ঋতুপর্ণা ভারত ম্যাচেও এক গোল করেছেন। ম্যাচের একদম শেষ মুহূর্তে পেনাল্টির আবেদন করেছিল নেপাল। তবে ৯০ মিনিটে সাবিত্রার শট যখন মাসুরা পারভিনের হাতে লাগে তখন শরীরের সঙ্গে লেগেছিল তার দুই হাত।
ম্যাচের যোগ করা সময়ে আরেকবার লিড নেয়ার সুযোগ পেয়েছিল বাংলাদেশ। তবে মারিয়ার ক্রসে শামসুন্নাহার জুনিয়রের হেড সরাসরি গোলরক্ষক অঞ্জিলার হাতে চলে যায়। নেপাল পরে চেষ্টা করেও গোল শোধ দিতে পারেনি। রেফারির শেষ বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গে উল্লাসে ফেটে পড়ে পুরো বাংলাদেশ দল। অন্যদিকে ভিন্নচিত্র তখন পুরো স্টেডিয়ামে। নেপালের পায়ে বল থাকলে একটু আগে যেখানে জন সমুদ্রের ঢেউ উঠতো সেই স্টেডিয়ামে তখন পিনপতন নীরবতা। ষষ্ঠ ফাইনালে ব্যর্থ হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন নেপালি মেয়েরা।