পেছন ফিরে তাকালে যে ছবিগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে, সেগুলো সেই সব অজস্র অমূল্য জীবনের, যারা অকালে ঝরে পড়ে গেছে। পরম শ্রদ্ধায় তাদের স্মরণ করি। কিন্তু সেই সঙ্গে এখন কী করণীয়—আজ বাংলাদেশে সে রকম মূল্যায়নেরও বড় প্রয়োজন। সে মূল্যায়নের একটি তাৎক্ষণিক প্রেক্ষিত আছে, একটি স্বল্পমেয়াদি প্রেক্ষিত আছে, একটি মধ্যমেয়াদি প্রেক্ষিত আছে এবং একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রেক্ষিত আছে।
তাৎক্ষণিকভাবে, প্রথম যে কাজটি করা প্রয়োজন তা হলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কর্মকাণ্ড শুরু করে দেওয়া। বলা প্রয়োজন যে এ–জাতীয় সরকার গঠনের কিছু কিছু সাংবিধানিক জটিলতার কথা আইনজ্ঞেরা বলছেন। তবে তাঁরা এটাও বলছেন যে বর্তমান অভূতপূর্ব পরিস্থিতি এবং তার নাজুকতাকে মাথায় রেখে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রক্রিয়াটিকে সামনে নিয়ে যেতে হবে। পরবর্তী সময়ে সাংবিধানিক ও আইনগত ব্যবস্থার মাধ্যমে এ প্রক্রিয়াটিকে বৈধতা দিতে হবে, যাতে এটা ভবিষ্যতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়।
দ্বিতীয়ত: আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী পুলিশ প্রশাসনের ভেঙে পড়া কাঠামোকে অবিলম্বে পুনঃস্থাপন করতে হবে। সন্দেহ নেই, সময়ের ধারায় পুলিশি কাঠামোর রাজনীতিকরণ এবং গত কয়েক সপ্তাহের পুলিশি কর্মকাণ্ডের ফলে পুলিশের প্রতি জনগণের বিক্ষুব্ধতা বর্তমানে অত্যন্ত গভীর এবং পুলিশ প্রশাসন একটি ভীতির মধ্যে আছে।
অনেকগুলো থানা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং অনেক থানা তালাবদ্ধ বা অরক্ষিত। দেশের আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করতে এবং নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করার জন্য পুলিশি প্রশাসনের আশু পুনঃস্থাপন অত্যন্ত জরুরি।
তৃতীয়ত: সব রকমের সহিংসতার বিরুদ্ধে আইনগত ও সামাজিক প্রতিরোধ নিশ্চিত করতে হবে। এসব সহিংসতার একটি দিক হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির ধ্বংসযজ্ঞ। রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির ধ্বংস কাম্য হতে পারে না, কারণ সেগুলো জনগণের সম্পদ। সেই সঙ্গে সব রকমের প্রতিহিংসাপরায়ণতা এবং লুটপাট রোধ করার ব্যবস্থা করতে হবে। সহিংসতার একটি অন্যতম মাত্রিকতা হচ্ছে সংখ্যালঘুদের জীবন, তাদের বাড়িঘর ও উপাসনালয়ের ওপরে আক্রমণ। অত্যন্ত আনন্দ এবং আশ্বাসের কথা হচ্ছে যে অতি সত্বর ছাত্র-জনতা যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের জানমাল ও উপাসনালয়ের নিরাপত্তা বিধান করছে। এ কাঠামোকে আরও জোরদার করে শক্ত ভিত্তির ওপরে দাঁড় করাতে হবে।
“অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তাৎক্ষণিক কর্মকাণ্ডের পঞ্চম কাজটি হবে গত কয়েক সপ্তাহের হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে বস্তুনিষ্ঠ তদন্ত করা এবং যারা এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী, তাদের আইনের আওতায় এনে বিচার করা এবং শাস্তি দেওয়া। এ ব্যাপারে দীর্ঘসূত্রতা এই পুরো প্রক্রিয়াকে নষ্ট করে দিতে পারে।”
চতুর্থত: এটা মনে রাখা দরকার, কোনো রকমের ইতিহাস-প্রতীকের ধ্বংস একটি জাতির জন্য মঙ্গলজনক হয় না। সেসব প্রতীকের মধ্যে রয়েছে চিত্র, শিল্পকর্ম, ভাস্কর্য; জাদুঘর। আমরা কোথায় যেতে চাই, সে জন্য আমরা কোথা থেকে এসেছি, তা জানাটা বড় দরকার।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক ভবনটিতে অগ্নিসংযোগ করে, জাতির পিতার ভাস্কর্য, ইতিহাসের মাইলফলকভিত্তিক ভাস্কর্য অথবা সাত বীরশ্রেষ্ঠর আবক্ষ ভাস্কর্যকে বিনষ্ট করার মানে জাতি হিসেবে আমাদের ঐতিহাসিক পথযাত্রা বিনষ্ট করা। আমাদের জাতিসত্তার জন্য এগুলো ক্ষমাহীন অপরাধ, যার যোগ্য শাস্তি হওয়া প্রয়োজন।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তাৎক্ষণিক কর্মকাণ্ডের পঞ্চম কাজটি হবে গত কয়েক সপ্তাহের হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে বস্তুনিষ্ঠ তদন্ত করা এবং যারা এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী, তাদের আইনের আওতায় এনে বিচার করা এবং শাস্তি দেওয়া। এ ব্যাপারে দীর্ঘসূত্রতা এই পুরো প্রক্রিয়াকে নষ্ট করে দিতে পারে।
স্বল্প-মেয়াদে প্রথমেই যে কাজটি করতে হবে, তা হচ্ছে একটি গণতান্ত্রিক, দৃশ্যমান, সর্বজনীন অংশগ্রহণমূলক আলাপ-আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করা এবং সে আলাপ-আলোচনার সঞ্চালন। সে আলাপ-আলোচনায় সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীর যেমন, নারী, তরুণ, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী জনসমষ্টি, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ—কার্যকর প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে।